কুরআন খতমের দুআ সম্পর্কে বিভ্রান্তি নিরসন

 




প্রশ্ন: কুরআন খতমের পরে বিশেষ কোনও দুআ পড়া কি হাদিস সম্মত?

উত্তর:
পাক ভারত উপমহাদেশে ছাপানো কুরআনের শেষাংশে কুরআন খতমের দুআ হিসেবে “আল্লাহুম্মা আনিস ওয়াহশাতী ফী ক্বাবরী…আল্লাহুম্মার হামনী বিল কুরআনি…” এ জাতীয় কিছু দুআ লেখা থাকায় আমাদের দেশের হাফেজ ও ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা কুরআন খতম করার পর অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে উক্ত দুআগুলো পাঠ করে থাকে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এ দুআগুলো যে সব হাদিসে বর্ণিত হয়েছে সেগুলো বিজ্ঞ মুহাদ্দিসদের দৃষ্টিতে মউযু (বানোয়াট) ও জইফ (দুর্বল) হিসেবে পরিগণিত। বিজ্ঞ আলেমদের গবেষণায় কুরআন খতমের জন্য বিশেষ কোনও দুআ বিশুদ্ধ হাদিসে বর্ণিত হয় নি।

❑ কুরআন খতমের বিশেষ দুআ বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়:

নিম্নে কুরআন খতমের দুআ হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত দুআগুলো যেসব হাদিসে বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে সংক্ষেপ মুহাদ্দিসদের অভিমত তুলে ধরা হল:

❂ ১ম দুআ:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন (!)
إذا خَتَمَ أحدُكُمْ فلْيِقُلْ : اللهمَّ آنِسْ وحْشَتِي فِي قبرِي
“কুরআন খতম করে পাঠ করবে: আল্লাহুম্মা আনিস ওয়াহশাতি ফি ক্বাবরি…।”
– শাইখ আলবানি বলেন, এ হাদিসটি موضوع বা বানোয়াট। [সিলসিলা যাইফা ওয়াল মাউযুআহ, হা/২৫৪৮]
– শাওকানি বলেন, في إسناده وضاع ”এ হাদিসের বর্ণনা সূত্রে একজন মিথ্যা হাদিস রচনাকারী বিদ্যমান রয়েছে।” [আল ফাওয়াদুল মাজমুআহ, ৩১০]
– সুয়ূতি বলেন, এ হাদিসটি জইফ (দুর্বল)। [আল জামিউস সাগির, হা/৫৬৯]

❂ ২য় দুআ: কুরআনের খতমের দুআ হিসেবে “আল্লা-হুম্মারহামনি বিল কুরআনি ওয়াজ আলহু লী ইমামা…” দুআটিও জইফ (দুর্বল):

حديث معضل بن قيس أن النبي صلى الله عليه وسلم كان يدعو عند ختم القرآن (اللهم ارحمني بالقرآن واجعله لي أماماً ونوراً وهدى ورحمةً اللهم ذكرني منه ما نسيت وعلمني منه ما جهلت وارزقني تلاوته آناء الليل واجعله لي حجة يا رب العالمين)
ذكره الغزالي في الإحياء وقال العراقي في تخريجه على الإحياء معضل

গাজালি এ হাদিসটি তার ‘এহিয়াউল উলুম’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন কিন্তু হাফেজ ইরাকি এ কিতাবটির তাখরিজ করতে গিয়ে এটিকে মুযাল (জইফ এর একটি প্রকার) বলেছেন।

প্রকৃতপক্ষে কুরআন খতমের নির্দিষ্ট কোনও দুআ হাদিসে বর্ণিত হয় নি- চাই সালাতের মধ্যে হোক বা সালাতের বাইরে হোক। কোনও সাহাবি বা তাবেঈ থেকেও এমন দুআ প্রমাণিত নয়। এমনকি চার মাজহাবের সম্মানিত ইমামদের থেকেও এ বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায় না। এবং যুগে যুগে যে সকল নির্ভরযোগ্য বিদগ্ধ আলেম ‘উলুমুল কুরআন’ বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছেন তারা কেউ তাদের গ্রন্থে কুরআন খতমের বিশেষ কোনও দুআ উল্লেখ করেন নি।

❑ কুরআন খতমের পর দুআ করা হলে অবশ্যই তা কবুল হবে-এ সংক্রান্ত হাদিসগুলো সহিহ নয়:

কুরআন খতম করার পর দুআ করা হলে তৎক্ষণাৎ বা বিলম্বে অবশ্যই তা কবুল হবে এবং জান্নাতে বিশেষ মর্যাদা লাভ হবে-মর্মে কতিপয় হাদিস পাওয়া যায় কিন্তু সেগুলোও সহিহ নয়। সে সকল হাদিস নিম্নরূপ:

حديث أنس رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال (إن لصاحب القرآن عند كل ختمة دعوة مستجابة، و شجرة في الجنة، لو أن غرابا طار من أصلها لم ينته إلى فرعها حتى يدركه الهرم)

أخرجه البيهقي في شعب الإيمان وقال الشيخ الألباني في ضعيف الجامع موضوع

2 – حديث ابن عباس أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال (من قرأ القرآن حتى ختمه كانت له دعوة مستجابة معجلة أو مؤخرة) رواه ابن عدي والبيهقي ومدار سنده على حفص بن عمر بن حكيم وهو واهي الحديث كما في ترجمته في (الميزان)

3 – حديث جابر أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال (إن لقارئ القرآن دعوة مستجابة، فإن شاء صاحبها تعجلها في الدنيا، و إن شاء أخرها إلى الآخرة) رواه ابن مردويه في التفسير وابن عدي في الكامل وقال عنه الألباني ضعيف في ضعيف الجامع

4 – حديث العرباض بن سارية أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ( … ومن ختم القرآن فله دعوة مستجابة) رواه الطبراني في الكبير وضعفه الألباني في ضعيف الجامع

❑ কুরআন খতমের পর দুআ করা হলে তা কবুলের সম্ভাবনা আছে:

ইসলামি আকিদার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ওসিলা। আর শরিয়ত সম্মত ওসিলা হল, যে কোনও ইবাদত করার পর তার ওসিলা দিয়ে আল্লাহর নিকট দুআ করা।
কুরআন খতম যেহেতু অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সেহেতু এর ওসিলা দিয়ে আল্লাহর নিকট দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ প্রার্থনা করলে তা কবুলের সম্ভাবনা রয়েছে। আনাস রা. কর্তৃক সালাতের বাইরে কুরআন খতমের পর দুআ করার বিষয়টি প্রমাণিত।

عن أنس بن مالك رضي الله عنه قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا ختم جمع أهله ودعا-
رواه البيهقي في شعب الإيمان ثم قال (ورفعه وهم وفي إسناده مجاهيل والصحيح رواية ابن المبارك عن مسعر موقوفا على أنس)

আর প্রশ্নে উল্লেখিত দুআগুলো পরবর্তী যুগের মানুষের তৈরি হলেও যেহেতু সেগুলোর মর্মার্থ ভালো (অর্থগত কোনও সমস্যা নাই) সেহেতু কেউ চাইলে তা পাঠ করতে পারে। কিন্তু সেগুলোকে হাদিসের দুআ মনে করা যাবে না বা কুরআন খতমের পর এই দুআগুলো পড়াকে আবশ্যক মনে করা যাবে না। অন্যথায় তা বিদআত হিসেবে গণ্য হবে।

❑ শাইখ উসাইমিন রাহ. এর ফতোয়া:

তারাবীহ্‌ নামাযে কুরআন খতম করার দু’আ পাঠ করার বিধান কি?

রমজান মাসে তারাবীহ্‌ নামাযে কুরআন খতম করার দু’আ পাঠ করার ব্যাপারে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সুন্নত বা সাহাবায়ে কেরাম থেকে কোন হাদিস আমি জানি না। খুব বেশি যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে, আনাস বিন মালেক রা. বর্ণিত হাদিস। ‘তিনি (আনাস) কুরআন খতম করলে পরিবারের লোকদের একত্রিত করে দু’আ করতেন।’ তবে এটা নামাযের বাইরের কথা।

কুরআন খতমের দুআ সুন্নত থেকে তো প্রমাণিত নয়ই তারপরও এর জন্য নির্দিষ্ট কিছু মসজিদে অতিরিক্ত ভিড় লক্ষ্য করা যায়। অতঃপর মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় নারী-পুরুষের সংমিশ্রণ ব্যাপক আকারে দেখা যায়। কিন্তু বিদ্বানদের কেউ বলেছেন, কুরআন খতম করার পর এই দুআ পাঠ করা মুস্তাহাব।

ইমাম যদি শেষ রাতের নামায সমাপ্ত করে বিতর নামাযে এই খতমে কুরআনের দুআ পাঠ করে এবং কুনূত পাঠ করে তবে কোন অসুবিধা নেই। কেননা বিতর নামাযে কুনূত শরিয়ত সম্মত। [ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, বিষয়: সালাত, ফতোয়া নং-২৮০, শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন রহ.]

❑ কুরআন তিলাওয়াতের বৈঠক শেষে নিম্নোক্ত দুআ পাঠ করা সুন্নত:

কোনও ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত শেষ করে উঠে যেতে চাইলে (চায় কুরআন খতম করে বৈঠক ত্যাগ করুক অথবা সামান্য কিছু তিলাওয়াত করে বৈঠক ত্যাগ করুক) নিম্নোক্ত দুআটি পাঠ করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অন্যতম সুন্নত।
দুআটি হল:
سُبْحَانَكَ وَبِحَمْدِكَ، لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ، أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ
উচ্চারণ: “সুবহানাকা ওয়াবি হামদিকা-লা-ইলা-হা ইল্লা আনতা। আসতাগফিরুকা ওয়া আতূবু ইলাইকা।”
অর্থ: (হে আল্লাহ) আমি তোমার সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তুমি ছাড়া সত্য কোনও উপাস্য নাই। তোমার কাছেই ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তোমার কাছেই প্রত্যাবর্তন করি।”

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: مَا جَلَسَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَجْلِسًا قَطُّ، وَلَا تَلَا قُرْآنًا، وَلَا صَلَّى صَلَاةً إِلَّا خَتَمَ ذَلِكَ بِكَلِمَاتٍ قَالَتْ: فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَرَاكَ مَا تَجْلِسُ مَجْلِسًا، وَلَا تَتْلُو قُرْآنًا، وَلَا تُصَلِّي صَلَاةً إِلَّا خَتَمْتَ بِهَؤُلَاءِ الْكَلِمَاتِ؟ قَالَ: ” نَعَمْ، مَنْ قَالَ خَيْرًا خُتِمَ لَهُ طَابَعٌ عَلَى ذَلِكَ الْخَيْرِ، وَمَنْ قَالَ شَرًّا كُنَّ لَهُ كَفَّارَةً: سُبْحَانَكَ وَبِحَمْدِكَ، لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ، أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ. أخرجه النسائي في السنن الكبرى, وفي عمل اليوم والليلة.
মোটকথা, কুরআন খতম করার পর কুরআন তিলাওয়াতের ওসিলায় আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখিরাতে যে কোনও কল্যাণের জন্য দুআ করা যাবে। তবে বিশেষ কোনও দুআকে নির্দিষ্ট করা যাবে না। কেননা, এ মর্মে বিশেষ কোনও দুআ বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়।
আল্লাহু আলাম।
– আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল-

$ok={Accept !} $days={365}

Our website uses cookies to improve your experience. Learn more
Accept !